রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৩

"মেরে তোর হাত-পা ভেঙে দেবো। ভিখিরী কোথাকার।"

এটা কোনো প্রকারে আমার লেখা নয় । সংগৃহীত । ভালো লেগেছে তাই আমার ব্লগে পাবলিশ করা । অনধিকার পাবলিশিং এর জন্য আগে থেকেই ক্ষমা চাইছি । ধন্যবাদ ।

"মেরে তোর হাত-পা ভেঙে দেবো। ভিখিরী কোথাকার।"
দিল্লীর বিজয়নগরের এক বস্তি অঞ্চলে ছোট্ট ছেলেটি থাকে।
পরনের শতছিন্ন জামাটি ধূলিধূসরিত।
গতকাল সন্ধ্যের পর থেকে আর এক কণাও খাবার জোটেনি। ক্ষিদে পেটেই রাস্তা দিয়ে একা একা চলছে বাচ্চা ছেলেটি।
ছেলেটির মাত্র ৯ বছর বয়স। সকলে তাকে ভলু নামেই চেনে।
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই ভলু লক্ষ্য করে, এক দোকানে গরম গরম সিঙ্গারা ভাজা হচ্ছে।
একেই ক্ষিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে, তার ওপর গরম সিঙ্গারা দেখে ভলুর জিভে জল এসে গেল। মনে হলো কেউ যেন মুখের ভিতরে বয়ে চলা খরস্রোতা নদীটির বাঁধ খুলে নিয়েছে।
"কাকু", দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে ভলু নিষ্পাপ গলায় ডেকে উঠলো।
দোকানদার ঠিক ততটাই রূঢ় কণ্ঠে বললেন "কি চাই টা কি?"
ভলু তার অসহায়তার কথা জানিয়ে বললো "আমাকে একটা সিঙ্গারা দেবে? আমার কাছে একটা পয়সাও নেই।"
"এখুনি এখান থেকে বেড়িয়ে যা বলছি"। অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সুরে দোকানদার বলে উঠলেন।
ক্ষুধার্ত ভলুর শুকনো ঠোঁট দুটো দোকানদারের বিশ্বাস অর্জনের শেষ একটা চেষ্টা করলো "কাল রাত থেকে কোনো খাবার পাইনি কাকু, খুব ক্ষিদে পেয়েছে। দাও না একটা সিঙ্গারা।"
"ভাগ এখান থেকে, নাহলে মেরে হাত পা ভেঙে দেবো। সালা ভিখারী।"
ভলু ভয় পেয়ে দু'পা পিছিয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পরে দোকানদার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ক্ষিদের জ্বালায় ভলুর ভয়ও ততক্ষনে বেশ কিছুটা স্তিমিত হয়ে পরেছে।
মনে সাহস সঞ্চয় করে, ছোট্ট ছোট্ট পায়ে ভলু সামনের দিকে এগিয়ে আসে। নিশ্চুপে প্লেট থেকে একটা সিঙ্গারা তুলে নেয়।
কিন্তু এই ঘটনা দোকানদারের নজর এড়ালো না। ভয়ানক রেগে গিয়ে তিনি চিৎকার করে উঠলেন "জানোয়ার। সালা চোর। এত সাহস হয় কি করে তোর"। গর্জে উঠে ভলুর হাত মুচড়িয়ে দেয় তিনি।
"কাকু ছেড়ে দাও আমার হাত। আমি চুরি করিনি, সিঙ্গারা গুলোতে হাত দিয়েছিলাম কেবল।" আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে ভলু।
"ওহ মা…আমার হাত"। যন্ত্রণায় ডুকরে কেঁদে ওঠে ছোট্ট ছেলেটি।
কিন্তু দোকানদার তাতে কর্ণপাত পর্যন্ত করলেন না। নিষ্ঠুর ভাবে ভলুর হাতে-পিঠে আঘাত করতে লাগলেন। ভলুর কনুই পর্যন্ত মুচড়ে দিলেন।
ছোট্ট ছেলেটির অবস্থা তখন মৃতপ্রায়।
ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে মাথাটা ঢেকে রাস্তাতেই বসে পড়লো ভলু। যেন বলতে চাইছে, "আমাকে যত খুশি মারো, কিন্তু আমার মাথায় আঘাত করো না।"
মার খেতে খেতে ভলুর চারিদিক যেন কিছুক্ষনের জন্য অন্ধকার হয়ে গেল। সে আর নিশ্বাস-প্রশ্বাসও ঠিক ভাবে নিতে পারছে না।
সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। পিঠে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। সম্ভবত ভলুর হাতটাও ভেঙে গেছে।
তীব্র যন্ত্রণায় কেঁদে ওঠে ভলু। শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে থাকে ভলু। নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটতে থাকে।
দিল্লীর এক বস্তিতে থাকে ভলু। নোংরা , অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যেই সে বড় হয়ে উঠছে। সরু সরু গলি ঘুপচির মধ্যে দুজন মানুষ পর্যন্ত পাশাপাশি হেঁটে যেতে পারবে না। সেই পথ দিয়েই ভলু দৌঁড়ে চলেছে।
একটা ছাদের তলায় এসে ভলু থামলো। এটাই নাকি এই ছোট্ট ছেলেটির ঘর। পুরোনো জীর্ণ একটা প্লাস্টিকের চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে পড়লো। দেওয়ালে টাঙানো মায়ের হাসিমুখের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ভলু অঝোরে কাঁদতে থাকে।
"মা তুমি কোথায়?"
"আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে।"
"মা, তুমি জানো, ওই দোকানদারটার কাছে একটা সিঙ্গারা চেয়েছিলাম বলে আমার হাত ভেঙে দিয়েছে।"
"আমাকে জানোয়ার বলেছে। বলেছে আমি নাকি চোর। আমাকে খুব মেরেছে, মা।"
"খুব যন্ত্রনা হচ্ছিলো আমার। আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আমার কনুই পর্যন্ত মুচড়ে দিয়েছে।"
"মা , তুমি তো আমাকে সবসময় বলতে আমি ঠিক মতো খাবার না খেলে, তুমি চলে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি তুমি যা বলবে সব করবো, যা খেতে দেবে সব খাবো। তুমি ফিরে এসো মা"।
দেওয়ালে টাঙানো মা এর নিষ্প্রাণ ছবি কেবল অসহায়ের মতো হাসতে থাকে।
হঠাৎই, ভলুর এই ছোট্ট ঘরে এক ভদ্রমহিলা আসলেন।
তিনি একজন সমাজ সেবিকা।
ভলুর দিকে তাকিয়ে বললেন "তুমি তোমার মা-বাবাকে একটু ডেকে দেবে? ওনাদের সাথে কিছু কথা আছে।"
ভলু কিছুই বলে না। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ক্রমাগতভাবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলে।
"কি হয়েছে তোমার হাতে?"
ভলু তাও কোনো উত্তর দেয় না। যন্ত্রণায় সে কেঁদেই চলেছে।
ভদ্রমহিলা ভলুকে সাথে করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ডাক্তারবাবু ভলুর হাতে প্লাস্টার করে দিলেন।
মিসেস ডিসুজা ভলুর জীবন সম্পর্কে সবকিছু জানতে পারলেন। এক মাতৃস্নেহে তাঁর হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে।
তিনি ভলুকে জিজ্ঞাসা করলেন
"তুমি পড়াশোনা করবে?"
ভলু মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
কিন্তু পরমুহূর্তেই কি যেন একটা চিন্তা করতে থাকে।
"আর খাবার"? ভলু খুব উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চায়।
"তোমাকে আর খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা করো। কেমন?"
"আর আমাকে এখন থেকে মা বলে ডেকো"। আলতো করে নিজের স্নেহের হাতটা ভলুর মাথায় রেখে সহাস্য মুখে তাকালেন মিসেস জেব্রিয়ানা ডিসুজা।
"ঠিকাছে মা"। ভলু অনায়াসে এমন ভাবে বলে উঠলো যেন তার রোজকার যাবতীয় সমস্যার সমস্ত সমাধান সে খুঁজে পেয়ে গেছে।
ভলু আর বস্তির ছেলে নেই।
কনভেন্ট স্কুল থেকে পড়াশোনা করে সে এখন উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে পারি দিয়েছে।
ভলু এখন একজন উচ্চশিক্ষিত যুবক। লন্ডন থেকে ফিরে এসে সে চশমার একটি নতুন ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠা করে। তার নতুন মা, হয়তো সাক্ষাৎ ভগবান, তাঁর নাম অনুযায়ী সে তার ব্র্যান্ডের নামকরণ করে 'জেব্রিয়ানা'। বর্তমান যুগে অতিরিক্তি মোবাইল আর ল্যাপটপ ব্যবহারের ফলে চোখে যে অতিরিক্ত প্রেসার পরে, তা রোধ করতে এই ব্র্যান্ডের চশমার জুড়ি মেলা ভার।
"আজকের খাবারের কন্টেনারগুলো সব রেডি তো?" ভলু ভাস্কর তার এসিস্ট্যান্টকে জিজ্ঞাসা করে।
"হ্যাঁ স্যার। প্রায় রেডি। আর মাত্র চারটে কন্টেনার প্যাক করা বাকি" এসিস্ট্যান্ট জানায়।
"ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি করো। আজ আমরা মদনপুর বস্তিতে যাবো। সমস্ত খাবার ওখানকার ফুটপাতে যারা থাকে, তাদের মধ্যে ভাগ করে দেবো। আর যদি কিছু বেঁচে যায়, তবে রাতে যারা ওখানে আশ্রয় নেয় তাদেরকেও দিয়ে আসবো।" ভলু ভাস্কর নির্দেশ দেয় তার এসিস্ট্যান্টকে এবং নিজের কোম্পানি জেব্রিয়ানার অন্যুয়াল রেভিনিউ চেক করতে শুরু করেন।
বেশিরভাগ সময়ই টেকনিশিয়ান, রিসার্চার আর সাপ্লায়ারদের দ্বারাই পরিবেষ্টিত থাকে এখন ভলু। তারা অবশ্য তাকে মিস্টার ভাস্কর নামেই চেনেন।
ভলুর মায়ের সেই ছবিটা আজও দেওয়ালে সুন্দর ভাবে টাঙানো আছে। তার কেবিনে চেয়ারের ঠিক পেছনটাতে।
কিন্তু আজ আর মায়ের মুখে সেই অসহায়ের হাসিটা নেই। বরং তাঁর চোখে মুখে গর্বের যে উজ্জ্বল হাসিটা দেখা যাচ্ছে তা পরিমাপ করা সম্ভব নয় কোনোভাবেই।
মায়ের কাছে মিস্টার ভাস্কর আজও সেই ছোট্ট ভলু। চিরকাল তাইই থাকবে।
আমি আগে মনে করতাম, ঈশ্বরের অস্তিত্ব হয়তো নেই। কিন্তু আজ বুঝতে পারি, কোথাও একটা চূড়ান্ত কোনো শক্তি অবশ্যই বিরাজ করছে। উপযুক্ত মুহূর্তে আমাদের সাহায্য করার জন্য সে তার সৈনিককে ঠিক প্রেরণ করবে।
জীবনে এই সত্যিটাই হয়তো শিখতে গিয়ে খুব দেরি হয়ে গেলো।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

বেশ্যা

                         বেশ্যা ----- বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম   সাধুর নগরে বেশ্যা মরেছে পাপের হয়েছে শেষ, বেশ্যার লাশ হবে না দাফন এইটা ...